আশ শেফা মধুঘর

বাদাবন বা সুন্দরবন, মউলি বা মৌয়াল, মৌমাছি, মধু ও বাঘ এর গল্প

বাদাবন বা সুন্দরবন, মউলি বা মৌয়াল, মৌমাছি, মধু বাঘ এর গল্পঃ

বারো ভাটি-আঠারো-ভাটির রাজ্য সুন্দরবন যার আঞ্চলিক নাম বাদাবন। সুন্দরবন স্থানীয়ভাবে বাদা বা বাদাবন, হুলোবন, শুলোবন, মাল, মহাল হিসেবে পরিচিত। বাদা মানে জোয়ার-ভাটা বয়ে যায় যে বনে।

ব্রিটিশ উপনিবেশের সময় এই বাদার নাম হয়ে যায় মহাল। মধুমহাল, গোলমহাল। সুন্দরবনে বৃক্ষবৈচিত্র্য থাকা সত্ত্বেও অনেকে বলে থাকেন ‘সুন্দরী’গাছের আধিক্যর কারণেই এই বন সুন্দরবন নাম পায়। তবে স্থানীয়ভাবে এই বন ‘বাদা’ নামেই পরিচিত। ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশে শ্বাসমূলীয় অরণ্য স্থানীয় ব্যক্তিরা তেলেগু ভাষায় ‘মাদাআদাভি’ বলেন। যদিও ‘মাদা’ বলতে স্থানীয় ব্যক্তিরা বাইনগাছকে বোঝান এবং অন্ধ্রপ্রদেশের শ্বাসমূলীয় বনে বাইনেরই আধিক্য বেশি। বাদাবনে মানুষ গাছ লাগায় না। এখানে জোয়ার-ভাটাই গাছ থেকে ঝরে পড়া ফল ও বীজ কাদা মাটিতে পুঁতে দেয়। সেখান থেকেই চারাগাছ জন্মে। জোয়ারের জলে ভেসে আসা বীজ ও ফল বনের ধারে চরের কাদামাটিতে আটকে যায়। কাদামাটিতে প্রথম জন্মায় ধানচি ঘাস। এসব ঘাস না থাকলে বীজ আটকাতে পারে না। যেসব ফল জোয়ারের স্রোতে বনের ভেতরে গিয়ে হুলোতে আটকায় সেসব গাছের চারা সেখানেই জন্মে। এভাবে দেখা যায় জোয়ারের টান এবং ফলের আকার ও ওজন বনের একেক স্তরে একেক গাছের বীজ নিয়ে যায়। আর তাই বাদাবনে একেক স্তরে একেক গাছের জন্ম হয়। আবার বনের ভেতর কোনো কোনো গাছের চারা ফল থেকেই গজিয়ে নিচে কাদামাটিতে আটকে যায়। এভাবেই বাদাবনের বিস্তার ঘটে। বাদাবনে অধিকাংশ গাছেরই জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় মাসে ফুল হয় এবং আষাঢ় মাসে বীজ ঝরে পড়ে। শ্রাবণ-ভাদ্র মাসে বনতলজুড়ে নতুন চারা দেখা যায়।

 

পাখি, হরিণ, বানর, মাছ বা পতঙ্গ বাদাবনের ফলমূল খেয়ে বাঁচে। তাদের অনেকেই কাঁচা ও পাকা ফল খেতে পারে। কিন্তু পাকলে মানুষ খেতে পারে, এমন কোনো ফল নেই বাদাবনে। কেওড়া হলো বাদাবনের সবচেয়ে বেশি আহরিত ও ভোজ্য ফল। কেওড়া দিয়ে সুন্দরবনের আশপাশের গ্রামে নোড়া, আচার, টক নামের নানা পদের খাবার তৈরি হয়। কেওড়া, হেন্তাল, ধুতল, বাবলে, জানা, ছইলা, গোল, বান্দা, ঘড়িয়া ও হরিণআড়ুগাছের ফল কাঁচা অবস্থাতেই খায় মানুষ। পাকলে এসব ফল মানুষ খেতে পারে না। তবে একমাত্র হরিণআড়ুর ফল পাকলেও কেউ কেউ খেয়ে দেখেন। কাঁচা সুন্দরী ফল পোক্ত হলে সিদ্ধ করে কষ-পানি ফেলে দিয়ে এর শাঁস চিংড়ি মাছ দিয়ে রান্না করে খাওয়া যায়। কখনো কেউ কেওড়ার কচি পাতা চিবিয়ে দেখে। কিন্তু বাদাবনে কোনো গাছের পাতাই মানুষের খাওয়ার জন্য নেই। তবে বনের ভেতরের দিকে উঁচু জায়গায় কোথাও কোথাও বনপুঁই ও কলমি নামে গাছ আছে। যার পাতা ও ডগা বাদায় থাকাকালীন বনজীবীরা রান্না করে খান। সাগরের কাছাকাছি চরে অনেক সময় জেইত্তপালং বা জেইদ্দপালং নামের একপ্রকার গাছ দেখা যায়, যার পাতা শাক হিসেবে রান্না করে খাওয়া যায়। তবে খুবই বিরল এসব গাছ মূল ছোট গাছ এবং বনে খুব একটা পাওয়া যায় না। বড় গাছের ভেতর কোনো গাছের পাতাই খাওয়া হয় না। বাদাবনের সব গাছই বনজীবীরা ব্যবহার করেন না। সব গাছের সব অংশও ব্যবহূত হয় না। গোলগাছের পাতা ঘর ছাওয়ার কাজে লাগে। হেন্তাল পাতা দিয়ে মধু সংগ্রহের সময় ধোঁয়া দিয়ে মৌমাছিকে চাক থেকে সরিয়ে দেওয়ার কারু বানানো হয়। কেওড়া ও গেওয়াগাছের পাতা ছাগলের খাদ্য হিসেবে ব্যবহূত হয়। কেওড়া, হেন্তাল, ধুতল, বাবলে, জানা, ছইলা, গোল ও হরিণআড়ুগাছের ফল কাঁচা অবস্থায় খায় মানুষ। সুন্দরী, গেওয়া ফলের বীজের শাঁস হাঁস-মুরগিকে খাওয়ানো হয়। পশুর, বাইন, গরানগাছের ডাল দিয়ে ঘরের বেড়া হয়। সুন্দরী ও পশুরের কাঠে আসবাবপত্র হয়। মধু চাক কাটার দায়ের বাঁট/আছাড় বানানো হয় খলসি ও গেওয়া কাঠ দিয়ে। গরান ও কেওড়ার ডালপালা জ্বালানি হিসেবে ব্যবহূত হয়। গরানের ছাল দিয়ে লাল রং বানানো যায় এবং কাপড় রাঙানো যায়। সুন্দরীগাছের ছাল বেটে মাথাব্যথায় লাগানো হয়। গেওয়া ও সেজিগাছের আঠা দিয়ে মাছ ধরা যায়। হরগোজা ও কেওড়ার চারা জ্বালানি হিসেবে কাজে লাগে। পশুরগাছের শুলো দিয়ে নারীরা চামচ, হাতা এসব নানা গৃহস্থালি জিনিস বানায় এবং বাচ্চারা খেলনা গুটি বানায়।

 

বনবাসী বনের নানা গাছপালা ও বন্য প্রাণের ওপর একে অপরে নির্ভর করে। বানর কেওড়ার ফল, ধানচিগাছের শিকড়, কেওড়ার ছোট শুলো, হেন্তালগাছের মাথি খায়। কেওড়া, পশুর ও গেওয়ার পাতা হরিণের প্রিয়। হরিণ কেওড়া, হেন্তাল ও আমুগাছের ফলও খায়। খলিসা ও বাইনের পাতাও খায় হরিণ। সুন্দরীগাছে জন্মানো চিলি নামে পরগাছার পাতাও হরিণ খায়।

 

 

বাদাবনের এক এক অংশে এক এক বন্য প্রাণের বিচরণ। বাদাবনে পাখিদের বিশেষ আবাসস্থলকে বাদাল বলে। সাতক্ষীরা রেঞ্জে চুনকুড়ি নদীর পাশে সুবদে-গোবদে খালের পাশে বাংলাদেশের বড় বাদাল। এক নদীর সঙ্গে আরেক নদীর সংযোগ খালকে ভাড়ানি বলে। অনেক জায়গায় একে দুইনে বা দোনেও বলে। আবার এক মুখ বন্ধ খালকে জোলা বলে। সুন্দরবনে অনেক জায়গার নাম হুলো। হুলো মানে নদীর বাঁক। এসব জায়গায় একটা বাঁক অনেক সময় বৃত্তাকার বা অর্ধবৃত্তাকার ঘুরে একটা জঙ্গল-দ্বীপের মতো আদল তৈরি করে। বাদাবন দিনে চারবার রূপ বদলায়। দিনে দুবার ভাটা ও দুবার জোয়ার হয়। বাদাবনের নদীতে নানা জাতের মাছ। মাছের নামেই বাদাবনের স্থানের নাম পরিচিত হয়েছে। পারশেখালী, কৈখালী, দাঁতিনাখালী, ভেটখালী, ভেটকীখালী, আমাদি, চিংড়াখালী, জোংড়াখালী। সুন্দরবনের আশপাশের এই স্থানগুলোর নাম মাছের নামে গড়ে উঠেছে। পারশে, দাঁতিনা, ভেটকী, চিংড়ি, আমাদি, জোংড়া সবই সুন্দরবনের নদী-খালে পাওয়া যায়। সাতক্ষীরার শ্যামনগরের বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের সুন্দরবন লাগোয়া এক প্রাচীন গ্রামের নাম দাঁতিনাখালী। সুন্দরবনের বিখ্যাত দাঁতিনা মাছের স্মৃতি নিয়ে এই গ্রাম। গ্রামের পাশে মালঞ্চ ও চুনো নদীর খালে দাঁতিনা মাছের আধিক্য ছিল বেশি। এই অঞ্চলটি দাঁতিনা মাছের বড় বিচরণস্থল ছিল। সুন্দরবনে তিন প্রকারের দাঁতিনা মাছ দেখা যায়। কাঁকরভাঙা, রুচো ও সাদা দাঁতিনা। দাঁতিনা মাছকে অনেকে দাঁইতনে মাছও বলে। কাঁকরভাঙা দাঁতিনা মাছের গায়ে কালো কালো ফুট (দাগ) আছে। দাঁতিনার ভেতর এদেরই ওজন বেশি হয়। দেখতে বড় হয়। বনের ভেতরের খালে থাকে। রুচো দাঁতিনার শরীরে সাদা সাদা দাগ থাকে। এদের ওজন ৫০০ থেকে ৮০০ গ্রাম হয়। জঙ্গলের পাশের খালে এদের দেখা যায়। একদম সাদা রঙের দাঁতিনা, এরা রুচো থেকে বড় হয়। বাদাবনের এক বিশেষ মাছের নাম বাঙশ। মাঝবয়সী কোনো বনজীবী নারীর ডান হাতের মাপে প্রায় চার হাত লম্বা হয় এই মাছ। বর্ষাকালে নদীতে এর আধিক্য বেশি থাকে। তবে শীতকালে এই মাছ বাদা থেকে উড়ে গ্রামে চলে আসে। বাদাবনের আশপাশের গ্রামে ধানের গোলা হয় উঠানের মাঝে। বাঙাশ মাছ ধানের গোলা থেকে ধান খেয়ে আবার উড়ে বাদায় ফিরে যায়। আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে বাদাবন থেকে কেওড়া ফল ঝরে পড়ে নদীতে। ঝরে পড়া কেওড়া ও বাইন ফল খেতে আসে পাঙাশ মাছ। কেওড়াভোজী পাঙাশ গায়েগতরে বড় হয় এবং খেতে কিছুটা টক স্বাদের হয়ে পড়ে। পাঙাশ মাছের আকার ও ওজন দেখে বোঝা যায় কেওড়ার ফলন কেমন হয়েছে। মাছের আকার বেড়ে যাওয়া মানে কেওড়ার ফলন বেশি হওয়া। কেওড়ার ফলন বেশি হওয়া মানে বনে ফুলের পরাগায়ন ভালো হয়েছে। পরাগায়ন ভালো হয়েছে মানে মৌমাছিদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ আছে। মৌমাছিরা নিরাপদে আছে মানে মধু-মোমের পরিমাণও ভালো হয়েছে। মৌয়ালিরা যদি ভালোভাবে মধু আহরণ করে এবং জেলেরা মাছ ধরতে পারে তবে বন বিভাগও ভালো রাজস্ব পায়। বনজীবী পরিবারগুলোও ভালো থাকে। মাছ, ধান, মৌমাছি, মানুষ, বন বিভাগ সব নিয়ে এক জটিল সংসার বাদাবন।

 

 

বাদাবনের সবচেয়ে দূরতম এবং কঠিনতম অঞ্চলের নাম আঠারভাটির পথ। বনজীবীদের কাছে এটি এক পবিত্র অঞ্চল। ১৮টি ভাটি এবং ১৮টি জোয়ার পাড়ি দিয়ে সে জায়গায় পৌঁছাতে হয়। একটি বাঘ এক দিনে এই আঠারভাটির পথের সমান দূরত্ব অতিক্রম করতে পারে। বাদাবনের বহুল চর্চিত মা বনবিবির পালা ও পুঁথিতে বারবার এই আঠারভাটির পথের বিবরণ আছে।

 

 

বাদাবনের একমাত্র বাহন নৌকা। সুন্দরবনে একেক নদী এবং একেক অংশে একেক কাজের জন্য নৌকার গড়ন একেক রকম। বাদাবনের প্রতিটি নৌকায় দুটি পবিত্র অঞ্চল থাকে। একটি হলো নৌকার সামনের দিক এবং আরেকটি হলো নৌকার মাঝামাঝি অংশ, যাকে নৌকার নাভি হিসেবে কল্পনা করা হয়। এই অংশ দুটিতে পা দিয়ে মাড়ানো হয় না। ভারতীয় সুন্দরবন অংশের দারুশিল্পীরা যখন দেশি নৌকার শিরদাঁড়া (মাঝখানের মেরুদণ্ডস্বরূপ) তৈরি করেন তখন তুলসী, সোনা, রুপা, তামা দিয়ে বিশ্বকর্মার পূজা করেন। ভারতীয় সুন্দরবন অংশে ঘুঘু, বেতনাই, ছিপ, পানসি, বালায়, ভাউলে, কিস্তি, ভড়, বজরা নৌকা দেখা যায়। বাংলাদেশের সুন্দরবন অংশে গল্লাবাড়ি, বেতনা, মধুকাটার নৌকা, ডিঙে, মাছ ধরার নৌকা, খেওয়া ও বাইচের নৌকা দেখা যায়। সুন্দরবনের জেলেরা নৌকাকে মায়ের গর্ভ হিসেবে দেখে এবং নৌকার নাভি অংশকে ‘যোনি’ অঙ্গ হিসেবে দেখে। বনেবাদায় তাই যখন নৌকায় কেউ অবস্থান করে তখন সে নিরাপদ থাকে। কারণ মায়ের গর্ভ থেকে কখনোই কারও ক্ষতি কেউ করে না বা করতেও পারে না। ঘুমানোর সময় উপুড় হয়ে নৌকায় ঘুমাতে নেই, যেহেতু মায়ের গর্ভ ও স্ত্রী অঙ্গ হিসেবে কল্পনা করা হয় তাই। নৌকায় থাকাকালে সাধারণত চিত হয়ে ঘুমানোর নিয়ম। চিত হয়ে ঘুমালে খাল ও জঙ্গলের নানা কিছু দেখাও যায় সহজে।

 

 

 

বাদাবনের ভেতর হঠাত্ প্রাকৃতিকভাবে ফাঁকা জায়গাকে চটক বলে। চটক জায়গায় গেওয়া, পশুর, বাইন, কাঁকড়ার মতো বড় বড় গাছ থাকে। বড় গাছের নিচে ঝোপজঙ্গল কম থাকে। চটক জায়গায় বাঘ কম থাকে। নদীর ভেতর হঠাত্ নতুন ছোট্ট চরে বন জন্ম নিলে তাকে টেক বলে। বাদাবনে নদীর তীর থেকে বনের ভেতর পর্যন্ত নানা গাছের নানা সারি। এক এক গাছের এক এক পরিবার। ধানি বা ধানচি চর থেকে শুরু হয়, তারপর তীর থেকে বনের ভেতরের দিকে থাকে হরগোজা, হেন্তাল, গোলপাতা, কেওড়া, বাইন, গেওয়া ও সুন্দরী। তুলনামূলকভাবে সাতক্ষীরা ও চাঁদপাই রেঞ্জে বাঘ, বনশূকর বেশি। এখানে মধুও বেশি। খুলনা রেঞ্জে সুন্দরীগাছ বেশি, সুন্দরীর শুলো বেশি বলে সেখানে বাঘ কম বিচরণ করে। খুলনা রেঞ্জে হরিণ বেশি। সাতক্ষীরা রেঞ্জে প্রবীণ কেওড়া, বাইন ও পশুরগাছের আধিক্য আবার খুলনা রেঞ্জে সুন্দরীর।

 

 

বাদাবনের রক্ষাকবচ হলেন মা বনবিবি। মা বনবিবি ও শাহজঙ্গলি ধর্মে মুসলিম, কিন্তু বাদাবনে তাঁরা পূজিত হন। তাদের নামে মুরগি ছেড়ে উত্সর্গ করে তারপর বাদায় প্রবেশ করতে হয়। মুসলিম কি সনাতন হিন্দু, বাঙালি কি আদিবাসী মুন্ডা, মাহাতো বা বাগদি সবাই মা বনবিবিকে মান্য করে বাদাবনে। বাদাবনের অনেক জায়গায় বনবিবির থান আছে। এমনতর থানগুলো পবিত্র জঙ্গল হিসেবে সুরক্ষিত হয়। সাতক্ষীরার শ্যামনগরের মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নের শামাগাজীর হুলো এমন এক বনবিবির থান। এসব থানে প্রতি মধু মৌসুমের শুরুতে বা কোনো মানত নিয়ে বনজীবীরা গিয়ে মোরগ-মুরগি উত্সর্গ করে ছেড়ে দেয়। এসব পবিত্র থানের গাছগাছড়া কেউ কাটে না। এই থানগুলোতে বৃক্ষ ও প্রাণীবৈচিত্র্য বেশি দেখা যায়। আজ পর্যন্ত বনবিবির থান এলাকায় কোনো বনজীবী বা বাঘ কেউ আক্রান্ত হয়নি।

 

 

বাংলাদেশের প্রাকৃতিক মধুর সবচেয়ে বড় উত্স এই সুন্দরবন। আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে বাদাবন থেকে কেওড়া ফল ঝরে পড়ে নদীতে। ঝরে পড়া কেওড়া ও বাইন ফল খেতে আসে পাঙাশ মাছ। কেওড়াভোজী পাঙাশ গায়েগতরে বড় হয় এবং খেতে কিছুটা টক স্বাদের হয়ে পড়ে। পাঙাশ মাছের আকার ও ওজন দেখে বোঝা যায় কেওড়ার ফলন কেমন হয়েছে। মাছের আকার বেড়ে যাওয়া মানে কেওড়ার ফলন বেশি হওয়া। কেওড়ার ফলন বেশি হওয়া মানে বনে ফুলের পরাগায়ন ভালো হয়েছে। পরাগায়ন ভালো হয়েছে মানে মৌমাছিদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ আছে। মৌমাছিরা নিরাপদে আছে মানে মধু-মোমের পরিমাণও ভালো হয়েছে।

 

বাদাবনের সবকিছুই চন্দ্রনির্ভর। বনজীবীদের জীবন গোণ ও ভাটিকার গণিত মেনে চলে। প্রতি ছয় ঘণ্টা পর পর জোয়ার-ভাটা হয়। প্রতি মাসে অমাবস্যা ও পূর্ণিমা তিথির তিন দিন আগ থেকে তিন দিন পর্যন্ত প্রায় এক সপ্তাহ হচ্ছে গোণমুখ। গোণমুখে বনজীবীরা বাদায় থাকে। এ সময় জোয়ারের প্রাবল্য বেড়ে যায়। প্রতি মাসে দুটি গোণমুখ আসে। প্রতি দশমী তিথিতে একটি নতুন গোণের জন্ম হয়। চতুর্দশী পর্যন্ত গোণ থাকে। পঞ্চমী থেকে দশমী পর্যন্ত অমাবস্যা বা পূর্ণিমা হবে। গোণমুখের পর সাত দিন ভাটিকা পড়ে। ভাটিকার সময় বনজীবীদের গ্রামে থাকার নিয়ম। একটি গোণমুখ ও একটি ভাটিকা হয় পূর্ণিমা তিথিতে, পরের গোণমুখ ও ভাটিকা মিল অমাবস্যা। ভাদ্রসংক্রান্তি থেকে শুরু করে আশ্বিনের শুরুতে হয় বছরের সবচেয়ে বড় গোণমুখ। একে বলে কলাকাটা গোণ। ভাদ্র মাসের শেষ সপ্তাহে যে গোণ হয় তাকে বলে পান্তাভাসান গোণ। গোণেই বছরের সবচেয়ে বড় জোয়ার ওঠে। গোণ ও ভাটিকা বাদাবনের জীবনে এমনই জড়িয়ে আছে গোণমুখের সময় মহাজন থেকে বনজীবীরা যে টাকা ধারকর্জ করে তাকে বলে গোণমুখী দাদন বা গোণদাদন। গোণমুখের সময় চিংড়ি ও কাঁকড়া বেশি পাওয়া যায় এবং ভাটিকার সময় সাদা মাছ বেশি পাওয়া যায়। কোকো নামে এক পাখি আছে, যা জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় মাসে ডিম পাড়ে ও বাচ্চা ফুটায়। কোকো পাখি কু-কু-কু-কু করে ডাকে। কোকো পাখি ডাকলে বোঝা যায় ভাটিকা লাগার সময় হয়েছে।

 

মাঝ বসন্তে পশ্চিম সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জের প্রায় সব মহুল গাছেই ফুল ফোটা শুরু হয়; খলসি, গেওয়া, গরান- আর কেওড়া গাছে থোকা থোকা ফুলের হাতছানি। এই ফুলের টানে উত্তরের পাহাড় থেকে উড়ে আসে অজস্র যাযাবর মৌমাছি-পৃথিবীর অন্যতম বড় মৌমাছি রক-বী, স্থানীয় নাম আগুনে মাছি, এর শরীরে আগুনের মত রাগ। এই মৌমাছিরা চৈত্র থেকে আষাঢ় পর্যন্ত দুনিয়ার সবচেয়ে বড় জোয়ার ভাটার-অঞ্চল সুন্দরবনে উদয়াস্ত খেটে তৈরি করে লাখ লাখ মৌচাক। সেই মধুর চাক ভাঙ্গা আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় ১৮ চৈত্র বা পহেলা এপ্রিলে মধুগোয়ালিনী রেঞ্জে ফরেস্ট ঘাটে। তিন মাসের জন্য- আষাঢ় মাসের ৭ তারিখ পর্যন্ত সরকারকে নির্দিষ্ট হারে রাজস্ব দিয়ে মৌয়াল বা মধুজীবীরা নৌকা সাজিয়ে ছোট ছোট দলে বাদাবনে হাজির হন।

 

 

নদীর পারে বাদার মাটি নরম, জোয়ারের সময় পানি ওঠে, ভাটায় সরে যায়। বনের উঁচু জায়গায় জোয়ারের পানি ওঠে না। ম্যানগ্রোভ জঙ্গলের গাছগুলির শাসমূল মাটি ফুঁড়ে ওঠে, মূলের আগা (শুলো) প্রায়শই ছুঁচাল হয়। ফলে খুব সাবধানে মাটিতে নামতে হয় নইলে পা ফুঁড়ে রক্তারক্তি, জোঁকেও ধরে। মৌয়ালদের খালি পা, এরা যদি মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া বা থাইল্যান্ডের মধু শিকারি হলে নিশ্চয় পায়ে গামবুট হাতে ওয়াকিটকি নিয়ে জঙ্গলে নামত।

 

বাদাবনের গাছেরা নোনা জলের গাছ। এদের হুদো বা হুলো আছে। মাটির তলা থেকে ওপরে উঠে আসা হুলো দিয়েই গাছেরা শ্বাস নেয়। বাদাবনের প্রায় গাছের পাতাই রসে ভরপুর। পাতা টিপলে নোনা স্বাদের পানি বের হয়। অনেক গাছে ফলের পেটেই চারা জন্মায়। নানা জাতের গাছ হলেও সব গাছে মৌমাছি চাক বানায় না। মৌমাছিরা সবচেয়ে বেশি চাক বানায় কাঁকড়া, জানা, পশুর ও গেওয়াগাছে। এসব গাছে চাক বানানোর কারণ গাছগুলোর কাণ্ড চওড়া এবং তাদের আশপাশ খোলামেলা থাকে। কারণ এসব গাছ একাই বেশ খানিকটা জায়গা নিয়ে বিস্তৃত থাকে। এসব গাছে চাক তৈরি করলে মৌচাকগুলো ভালো হাওয়া-বাতাস পায়। তারপরই মৌমাছিদের পছন্দ বাইন ও গরান। তুলনামূলকভাবে জানা, পশুর ও কাঁকড়াগাছে বানানো চাকের আকার বড় হয়। এসব চাকে অনেক মৌমাছি একসঙ্গে থাকে। এদের সমাজ বড় সমাজ। কিন্তু গরানগাছে বানানো চাক ছোট হয় এবং এখানে মৌমাছিদের সংখ্যাও কম থাকে, মধুও কম হয়। হেন্তাল ও হরগোজার ঝোপও মৌমাছির প্রিয় আবাসস্থল, অনেক মৌচাক গেওয়া, ধুন্দল, পশুরের বড় বড় ঢোঁড়ের ভেতর দেখা যায়। কাঁকড়াগাছের ডালপালা সব সময় হেলা (বাঁকা) হয়ে লম্বা হয়, যা চাক বানাতে মৌমাছিদের পছন্দ। কারণ বাঁকানো ডালে ও ঝোপে চাক বানালে চাক টেকসই বেশি হয়। ঝড়, বাতাস ও জোয়ার থেকে সুরক্ষিত থাকে।

 

চান্দা, বনলেবু ও গোলগাছে সাধারণত মৌমাছি চাক বানায় না। বনলেবুর গাছের ডাল চিকন ও গোলের ডাল পিচ্ছিল ও দ্রুত পচে যায়। চান্দাগাছের ডালের ছালে একধরনের গন্ধ আছে। এসব কারণে এসব গাছে মৌমাছি চাক বানায় না। সুন্দরীগাছ থেকে মধু সংগ্রহ না করলেও এই গাছের ধরন এমন যে মৌমাছি চাক বানাতে পছন্দ করে। হেন্তাল গাছের ঝোপে চাক বানাতে পছন্দ করে মৌমাছি, কারণ ঝোপের ভেতর সরাসরি রোদ লাগে না এবং জায়গাটি তুলনামূলকভাবে ঠান্ডা থাকে। সাতক্ষীরা রেঞ্জে গরান ও খলসিগাছ বেশি বলে মৌচাক বেশি ও মধু বেশি। তুলনামূলকভাবে খুলনা রেঞ্জে গাছের উচ্চতা বেশি, তাই মৌমাছি সেখানে সাতক্ষীরা রেঞ্জের পর চাক তৈরি করে। বাইন ও সুন্দরীগাছে বানানো চাক থেকে মধু সংগ্রহ করা খুব কঠিন। গাছগুলো সোজা ও লম্বা ধরনের, গাছে ওঠার জন্য ধরার মতো কোনো ডালপালা নেই। চান্দাগাছে মৌমাছি কখনোই চাক বানায় না। চান্দাগাছের বাকল চিবালে মুখ লাল হয়ে যায়। বনলেবুগাছে মৌমাছি চাক বানায় না। বনলেবুর ডাল খুব চিকন, চাকের ভার সইতে পারে না। গোলফলের ডালেও চাক হয় না। কারণ গোলের ডাল খুব পিচ্ছিল ও তেলতেলে। খুব সহজেই পানি লেগে ডাল পচে যায়।

 

বাদাবনে একেক ফুলের একেক রং। আর ফুলের রঙেই বদলে যায় মধুর স্বাদ। জানাগাছের ফুল নীলচে সাদা, সুন্দরীর লাল, হরিণআড়ুর ফুল লালচে, বাইনের লাল, গেওয়ার সোনালি, কিরপি-ঢালচাকা-পশুরের লালচে সাদা, কাঁকড়ার সবুজ, গোলের লালচে ও হরগোজার ফুল বেগুনি। এ ছাড়া বাদাবনের প্রায় গাছের ফুলের রংই সাদা। ‘হিন্দুদের ঢাকে বাড়ি পড়লে’ মানে শারদীয় দুর্গোত্সবের সময় কেওড়ার ফুল ফোটা শুরু হয়। মাঘ মাসে ফোটে গরানের নীলচে ফুল ও তরার সাদা ফুল খলিসা ফুটতে শুরু করে ফাল্গুন থেকে। কিরপি, ঢালচাকা, পশুর, ধুন্দল, গুঁড়ে, কাঁকড়া, কালোলতা, হরগোজা, গোল, জানা, বনলেবু, কেয়া, লাটমে, সুন্দরী, ধানি, বাউলে লতা, বাঁকঝাঁকা, হরিণআড়ু, কেওড়া, বাইন, গেওয়ার ফুল ফাল্গুন-চৈত্র থেকে ফোটা শুরু হয় এবং প্রায় আষাঢ়-শ্রাবণ পর্যন্ত অনেকের ফুল থাকে। এক ফোঁটা মধু সংগ্রহ করতে একটি মৌমাছিকে প্রায় আশিটি ফুলে যেতে হয়। চাকের ভেতর এক কেজি মধু জমাতে মৌমাছিদের নিজের বসতি চাক থেকে নানা ফুলে ফুলে যাতায়াত করতে হয় প্রায় দেড় লাখবার। নানান মধুর ভেতর আগুনে মৌমাছিদের চাকের পদ্মমধু স্বাদে ও গন্ধে সেরা। এটি খলসি ফুলের মধু। বাদাবনের প্রায় ফুল থেকে আহরিত মধু সাদা রঙের হলেও ঢালচাকার মধু লালচে ও গেওয়ার মধু কিছুটা সোনালি আভার। গরান ফুল থেকেই পাওয়া যায় সবচেয়ে বেশি মধু, লাল রঙের এই মধুর স্বাদ ঝাঁজালো মিষ্টি। কেওড়ার মধু হালকা টক, গেওয়ার মধু একটা কষা তিতকি স্বাদের। বাইন ও গেওয়ার মধু তিতা স্বাদের। রং হলদে এবং ঝাঁজ বেশি।

 

 

বনে গাছে গাছে ফুল ফুটলে বনজুড়ে মৌমাছিরা নাচে। প্রতিটি মৌচাকে নানা জাতের মৌপোকা থাকে। প্রতিটি চাকের প্রধান পোকাটি থাকে অনেক বড়, এর কাজ শুধু বাচ্চা জন্ম দেওয়া। এই পোকাকে মাইয়ে পোকা বা আলসি পোকা বলে। এই পোকা কখনোই মধু আনতে যায় না। মৌচাক থেকে মধু সংগ্রহ করার সময় খুব সাবধানে প্রথমেই চাকের ভেতর এই আলসি পোকা ও চাকের বাচ্চা পোকাদের বাঁচাতে হয়। মৌয়াল পরিবারে ছোট থেকেই এই শিক্ষা দেওয়া হয়। চাকের যে অংশে পোকারা থাকে সেই অংশটি খুব যত্ন করে সুরক্ষা করা হয়। কারু জ্বালিয়ে ধোঁয়া দিয়ে চাকের মধু জমানো অংশের বড় মৌমাছিদের তাড়ানো হয়। আলসি পোকাকে পবিত্র প্রাণ হিসেবে দেখা হয়। আলসি পোকা ও বাচ্চা পোকাদের মারলে পাপ হয় এবং মা বনবিবি রুষ্ট হন। এসব পোকা না বাঁচলে নতুন চাক হবে না, চাক না হলে মধু হবে না। মৌপোকারা বন ঘুরে ঘুরে মধুর সন্ধান করে। কোথায় কেমন জাতের মধু আছে তার নমুনা নিয়ে আসে। তারপর চাকের কাছে এসে নেচে নেচে মধুর উত্সস্থল কোথায় আছে তা দেখায়। মৌপোকার নাচন দেখে বনের কোন অংশে কেমন ফুল ফুটেছে তা বোঝা যায়।

 

গাছ থেকে মধু খেয়ে এবং সংগ্রহ করে যেসব মৌমাছি চাকের দিকে ফিরে আসে তাদের বোঝাই পোকা বলে। এসব পোকা চাকবরাবর উড়ে আসে, অন্য কোনো দিকে তারা যায় না। তাদের শরীর ভার থাকে। শরীরে একটা ভাব থাকে। চাকা থেকে মধু সংগ্রহ করতে বের হওয়া মৌমাছিদের খালিন পোকা বলে। তারা মধু সংগ্রহ করতে যাওয়ার আগে চাকের নানা দিকে ঘোরাফেরা করে অন্যদের দেখায় কোথায় ভালো মধুর উত্স আছে। মৌপুদের এই নাচ খুব সুন্দর লাগে দেখতে। তারা সোজা যায় না, তাদের শরীর হালকা থাকে। বোঝাই পোকা দেখে তাদের পেছন পেছন এলে মধুর চাক পাওয়া যায়।

 

ফুল থেকে পরাগরেণু সংগ্রহ করে মৌমাছিরা গুটলি করে চাকে জমিয়ে রাখে। গুটলি দিয়ে তারা চাকের মুখ বন্ধ করে। গুটলি হলো পরাগরেণুর দলা। এসব গুটলির ওপর নির্ভর করে চাকের স্থায়িত্ব। কোনো গুটলি বেশি আঠালো, কোনোটা ঝুরঝুরে। বৃষ্টি ও বাতাসের ঝাপটা থেকে গুটলিই মধুকে সুরক্ষা করে চাকের ভেতর। একেক ফুল থেকে সংগ্রহ করা গুটলিও একেক রকম। গেওয়া ও সুন্দরীগাছ থেকে সংগ্রহ করা পরাগরেণুর গুটলি হলুদ রঙের। কেওড়া ও গরানের গুটলি খয়েরি রঙের। বাইনের গুটলি হলদে-খয়েরি। চাকের গুটলির রং দেখেও বোঝা যায় চাকে কোন গাছ থেকে বেশি মধু সংগ্রহ করা হয়েছে। হেন্তালগাছ থেকে মৌমাছিরা মধু সংগ্রহ করে না, শুধু পরাগরেণু সংগ্রহ করে। তাই অনেক চাকে হেন্তালের গুটলি দেখা যায়।

 

কখনো কখনো মৌমাছিরা দলবেঁধে নদীতে ঝাঁপিয়ে আত্মাহুতি দেয়। বাংলা ভাদ্র-আশ্বিন মাসে বেশি দেখা যায়। দেখা যায় ঝাঁক বেঁধে একদল মৌমাছি উড়ে উড়ে নদীর মাঝবরাবর এসে তারপর পানিতে পড়ে যায়। তারপর পানিতে তাদের মৃতদেহ ভেসে ওঠে। তবে হেন্তাল ও হুদোগাছের ঝোপে যেসব চাক থাকে চৈত্র মাসের গরমে সেসব চাকের মধু অনেক গরম হয়ে যায়। মধুর গরমে থাকতে না পেরে চাক থেকে মৌমাছিরা তখন বাইরে বেরিয়ে আসে।

 

বনে ঢুকে মৌয়ালদের অভিজ্ঞ চোখ গাছে গাছে চাক খুঁজে বেড়ায়। ‘সাজুন’ (সর্দার) পুরো দলকে (১২ জনে এক নৌকার মৌ দল) ‘ছাটা’ (কাজ) ভাগ করে দেয়। দুজন থাকে চাক কাটার দায়িত্বে, আর অন্য দুজন বড় টিন বা প্লাষ্টিকের পাত্র নিয়ে চলে দলের সঙ্গে, বাকিরা হাতে লাঠি আর মুখে জিকির তুলে এগিয়ে যায়। যেতে যেতে মৌচাক দেখলে আল্লাহ আকবর বলে হাঁক ছাড়ে, হাঁক শুনে সহ-মৌয়ালরা যে যার জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়ে। চাক পেলে প্রথমই কাজ হলো শুকনো পাতা পুড়িয়ে ‘ধোমা’ (ধুয়া) দিয়ে মৌমাছি তাড়ানো, মৌমাছি সরে গেলে চার জন মৌয়াল মৌচাকের দিকে এগিয়ে যায়, চাকের অংশ বড়ো দা দিয়ে কেটে টিনের বা প্লাস্টিকের পাত্রে রাখে। পারমিট দেবার সময় বনবিভাগের কর্তারা প্রত্যেক মৌয়াল দলকে পুরো চাক না কেটে চাকের পেছনের অংশটা রেখে দিতে নির্দেশ দেন। কারণ ঐ অংশে থাকে খোকা মৌমাছিরা। বাচ্চা রেখে চাক কাটলে মৌমাছিরা ফিরে আসে চাকে এবং দিন পনেরো পর মধুসহ আবার চাক ভাঙ্গা যায়।

 

শ্রীপঞ্চমীর দিনে মৌপোকারা উড়ে আসে বাদাবনে। বন ঘুরে ঘুরে চাক বানানোর গাছ পছন্দ করে। এ সময় তারা আড়াইঘর চাক তৈরি করে প্রথম। প্রতিবছর নিয়ম করে মৌয়ালরা মধুচাক না কাটলে পরের বছর মৌচাক ও মধুর পরিমাণ অনেক কমে যাবে। এক ফোঁটা হলেও মধুচাক কেটে ঝরাতে হবে। মধুর চাক থেকে মধু সংগ্রহ করা হয় বলেই মৌমাছিরা আবার মধু সংগ্রহ করে। তা না হলে চাকে জমা মধু খেয়ে খেয়ে তারা অলস ও ভারী পোকা হয়ে যায়। এভাবে তাদের শক্তি কমে যায়। মৌমাছিরা যদি অলসভাবে চাকে বসে থাকে এবং বনের ফুলে ফুলে না যায় তবে গাছের মিলন বন্ধ হয়ে যাবে। মৌমাছির চাকে গুটলি দেখেই বোঝা যায় কেমন মিলন হয়েছে বনের গাছে। ঠিক একইভাবে এক বছর গোলপাতা না কাটলে, গোলের ঝাঢ় পরিষ্কার করে না দিলে পরের বছর গোলপাতা জন্মাবে কম। গোলের মাইঝ পাতা রেখে নিয়ম করে কাটতে হয়। পাতা না কাটলে এমনিতেই মরে শুকিয়ে পচে গিয়ে তা নতুন পাতার বৃদ্ধি ও বিকাশে বাধা দেয়।

 

 

সুন্দরবনের মধুর কথা বলতে গেলে বাঘের কথাও এসে যায়।বাদাবনে জলে কুমির, ডাঙায় বাঘ। বাঘ ও কুমির মানুষের আরাধনা ও বন্দনার অংশ। বাদাবনের রক্ষাকবচ মা বনবিবির বাহন হলো বাঘ। বনবিবির পূজার সময় মাটি দিয়ে বাঘ বানানো হয়, তার ওপর চেপে বসে বনবিবি। চৈত্র মাসে বাদাবনের ধর্মদেল উত্সবে মাটি দিয়ে কুমির বানানো হয়। কুমির, ধনামনা, সাগরপিড়ি, সূর্যপিড়ি, কামদেব, নীলদেব, মালঞ্চ মাটি দিয়ে বানানো হয়। ধানজমিন বা পুকুরের নরম মাটি দিয়ে কুমির বানানো হয় এবং সারা শরীরে খেজুর ফল গেঁথে দেওয়া হয়। বনবিবি পূজা ও ধর্মদেল উত্সবে বাঘ ও কুমিরের সুস্থ থাকার জন্য প্রার্থনা করা হয়। পাশাপাশি বাঘ ও কুমির যাতে মানুষের কোনো ক্ষতি না করে এ জন্যও আবদার করা হয়। বাদাবনে কুমিরকে সাধারণত গন্ধকালী হিসেবে দেখা হয়। ত্রেতা যুগে গন্ধকালী নাচতে নাচতে একদিন ধনপতি কুবেরের বাড়ি যায়। কিন্তু নাচতে নাচতে তার পা লেগে যায় কুবের মুনির শরীরে। মুনির অভিশাপে গন্ধকালী কুমির হয়ে গন্ধমাদন থেকে বাদাবনে চলে আসে। পাশাপাশি বাদাবনে বাঘকে মনে করা হয় দক্ষিণরায়। বাঘ যখন মানুষকে আক্রমণ করে তখন মনে করা হয়, দক্ষিণরায় বাঘের রূপ ধরে সেটি করেছে। বাঘ অসুস্থ হলে বা দীর্ঘ সময় রোগে ভোগার পর কিংবা আহত হলে এবং বয়স বাড়লে আশপাশে শিকার ধরতে না পেরে মানুষের ওপর আক্রমণ করে। কারণ তুলনামূলকভাবে মানুষকে আক্রমণ করা সহজ। একবার বাঘ মানুষের শরীরের রক্তের স্বাদ পেলে সে আর তা না খেয়ে থাকতে পারে না। মানুষের রক্তে বাঘের বুদ্ধি ও শক্তি বেড়ে যায়। বাঘ তখন উন্মত্ত হয়ে ওঠে। বাদা থেকে নদী সাঁতরে মানুষের গ্রামে চলে আসে। হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল ধরতে গিয়ে অনেক সময় মানুষের হাতে বেঘোরে প্রায় হারায়। মানুষশিকারি বাঘ চলার সময় একেবারেই কোনো শব্দ করে না। এমনকি কাদামাটিতে তার পায়ের কড়ও স্পষ্টভাবে পড়ে না। কারণ হাঁটার সময় সে পা পাক দেয়, তাই ছাপ থেবড়ে যায়। বাঘ যখন প্রথম মানুষকে আক্রমণ করে শিকার করে তখন সেই বাঘের ভেতর একধরনের উত্তেজনা থাকে। বাঘের তখন পেছনের পায়ের দুই ঊরু অনবরত কাঁপতে থাকে। বাঘ ফিনকি দিয়ে ছোটা রক্ত চেটে চেটে খায়। প্রথমবার বাঘ মাংস কামড়ে ছিঁড়ে খায় না। রক্ত খায় আর একটু পরপর পানি খেতে যায়। কয়েক দিন ধরে বাঘটি লাশের কাছে থাকে, যদি লাশটি সরিয়ে না নেওয়া হয়। তারপর সে মাংস কামড়ে খাওয়া শুরু করে। কিন্তু প্রথমবার শিকারের পর বাঘের পা কাঁপা কমতে থাকে। যে বাঘ যত বেশি মানুষ শিকার করে ধীরে ধীরে এই পা কাঁপা বন্ধ হয়ে যায়। বাঘের পায়ের কড় দেখেও বোঝা যায় এটি মানুষশিকারি বাঘ কি না। এমনিতে বাঘের পায়ের কড় থেকে মেছি ও হুলো শনাক্ত করা যায়। কিন্তু মানুষখেকো বাঘের ক্ষেত্রে মেছি ও হুলো শনাক্ত করা কঠিন। তাদের বাঁ পায়ের কড়ে পাঁচটি আঙুলের ছাপ এবং ডান পায়ের কড়ে চারটি আঙুলের ছাপ দেখা যায়। মানুষশিকারি বাঘ বেশিদিন বাঁচে না। কারণ সে বেশিদূর দৌড়ে যেতে পারে না, খাবার খাওয়ার পর অলস বসে ঝিমায়। মানুষশিকারি বাঘের ঘুম ভালো হয় না। শরীরে একটা ঝিমুনি এসে যায়। মানুষশিকারি বাঘের কোনো কারণে মাথা ও কপালে ঘা হলে সে আর বাঁচে না। কারণ বাঘ নিজের জিব দিয়ে সারাক্ষণ শরীর পরিষ্কার করে ও চাটে। জিব উল্টিয়ে মাথা ও কপাল চাটা সম্ভব হয় না বলে এই ঘা ভালো হয় না এবং শরীরে ছড়িয়ে যায়। প্রাণিকুলের ভেতর বাঘ হচ্ছে হিংসা জাত। কারণ বাচ্চা হওয়ার পর অনেক সময় নিজের বাচ্চাদেরও খেয়ে ফেলে হুলো বাঘ। তবে মেছি বাঘ বাচ্চাদের সামলে রাখার জন্য যুদ্ধ করে। মানুষশিকারি বাঘ মানুষকে আক্রমণ করলে প্রথমে ফিনকি দিয়ে ছোটা রক্ত খায়। তবে এরপর শরীরের মাংস খাওয়া শুরু করে। বাঘে ধরলে প্রথমেই পুরুষদের ক্ষেত্রে পুরুষাঙ্গ এবং মেয়েদের ক্ষেত্রে স্তন খায় বাঘ। পুরুষাঙ্গ ও স্তন দিয়েই বাঘ খাওয়া শুরু করে। সাধারণত বাঘ মানুষের মাথা খায় না। কোমরের নিচের অংশ থেকে পা পর্যন্ত, পেট এবং ঘাড়ের অংশ এসবও খায় বাঘ। বাঘ সাধারণত মানুষের ভেতর পুরুষদেরই বেশি আক্রমণ করে। বাঘ নারীদের মাংস খায় না। যদিও বাঘের আক্রমণে কিছু নারীর মৃত্যু হয়েছে, তবে বাঘ তাদের শরীর খায়নি।মানুষের ঘাড়ে শরীরের সব শিরা এসে জোড়া লাগে। বাঘ যখন পেছন থেকে কোনো মানুষকে আক্রমণ করে তখন ঘাড়ে কামড় বসায় এবং ঘাড় মটকে দেয়। মানুষ তখন বিড়ালের মতো ছটফট করে অজ্ঞান হয়ে যায়। বাঘের নখ ও দাঁত অনেক বড়, তা মানুষের ঘাড়ে ঢুকিয়ে দেয়।

 

 

মধু সংগ্রহ করতে গেলে মৌয়ালদের বাঘের নাড়ী- নক্ষত্র জানতে হয়। মৌয়ালরা আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে বাদায় ঢুকতে পারে না, অকারণে বাঘকে আহত করা বা মারা তাদের জন্য নিষিদ্ধ। তাই বাঘকে সামাল দেবার জন্য তাদের মধ্যে গড়ে উঠেছে অনেক তুকতাক, কুসংস্কার, অভ্যাস ও বিধি নিষেধ। প্রাচীনকাল থেকেই সুন্দরবনের অধিপতি রূপে একাধিক পীর দেবতার নাম পরিচয় ও পূজা মানত প্রচলিত আছে। তারা হলেন গাজী পীর, দক্ষিণ রায়, বনবিবি, বন দূর্গা, নারায়ণী ইত্যাদি। বস্তুত তাদের কোনো শাস্ত্রীয় ভিত্তি নেই, তারা সম্পূর্ণ লৌকিক। লোক সংস্কৃতি থেকেই তাদের জন্ম, লোকমানস তাদের লালন করেছে। বনে যাওয়ার পথে তাদের থান বা বেদী আছে। বেদীতে তারা কারও কারো প্রতীকী মূর্তি, কারো প্রতীক প্রস্তর খন্ড রাখা আছে। বনজীবীরা যাওয়া আসার পথে তাদের উদ্দেশ্যে মন্ত্র পাঠ ও মানত করে। তাদের আরাধ্য দেবতা ও পীর বন্য প্রানীর আক্রমন থেকে রক্ষা করেন। তারা কাঠ পাতা, মধু, মাছ সংগ্রহ করে নির্বিঘ্নে গৃহে প্রত্যাবর্তন করে। এর অনেকটাই অবৈজ্ঞানিক, আবার অনেক কিছুই নিবিড় প্রকৃতি পর্যবেক্ষণের ফল। ফলে সব মধু সংগ্রহকারী দলে একজন গুনিন থাকে, তাদের কাজ মন্ত্র পড়ে বাঘের মুখ বন্ধ করে দেয়া, বাঘকে দূরে সরিয়ে রাখা। নিদু মোড়ল, নীলডুমুর, বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়ন, শ্যামনগর, সাতক্ষীরা, বিখ্যাত গুনিন ছিলেন। বনের বাঘকে কাছে ডেকে এনে মাছ খাওয়াতেন, গোলপাতা বিছিয়ে ঘুম পারাতেন। প্রবীণ বয়সে বাঘের কামড়ে মারা যান। কবিরাজ সুশীল মণ্ডল, পূর্ব কালিনগর, মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়ন, সাতক্ষীরা, শ্যামনগর, সুন্দরবনের বাঘের আক্রমণে আহত রোগীর বিখ্যাত চিকিত্সক। এ পর্যন্ত প্রায় ১৫০ বাঘে ধরা মানুষের চিকিত্সা করেছেন এবং প্রায় ২০ জন কুমির ও কামটে কাটা। তাঁর চিকিত্সাবিদ্যা জানতে ইতালি, জাপান ও ইউরোপ থেকে অনেকে বাংলাদেশিদের সঙ্গে এসে চাপ দিয়েছেন অনেকবার। তিনি এই বিদ্যা সুরক্ষা করেছেন।

 

বনবিবির উদ্দেশ্যে প্রার্থনা

তবে বাস্তব সত্য হলো তন্ত্র মন্ত্র সত্ত্বেও বাঘের আক্রমণ ঠেকানো যায় না। বাঘ জঙ্গলে যেমন, নৌকায় ঘুমন্ত মৌয়ালদেরও তেমনি চুপিসারে আক্রমণ করে। অনেক গুনিনও বাঘের পেটে যায়। আজকাল তরুণ মৌয়ালদের অনেকেই মন্ত্র-তন্ত্র গুনিনে বিশ্বাস করে না, তবু লোকাচার অনুযায়ী দলে একজন গুনিন নিতে হয়। কুসংস্কারের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলার আগে মৌয়ালদের হাতে ওয়াকিটকি, জোরালো টর্চ, শব্দ তৈরির ভাইব্রেটার যে শব্দে বাঘ ভয় পায়, মৌয়ালদের মাথায় ঘাড়ে কাঁটা লাগানো হেলমেট বা খাঁচা আর জঙ্গলে ঘুরবার জুতোর ব্যবস্থা করতে হবে। তা না হলে সেই গুনিন আর কুসংস্কার ভোল পাল্টে বেঁচেবর্তে থাকবে।

 

চাকভাঙ্গা-মধু শব্দটির গায়ে যত রোমান্টিকতা জড়িয়ে আছে, মধু শিকারীদের পেশায় কিন্তু রোমান্টিকতার কোনো লেশ মাত্র নাই। সাপ খোপ আর বন্য পশুর আক্রমণ এড়িয়ে প্রাণ হাতে করে তাদের জঙ্গলে ঢুকতে হয়। প্রতি ফোঁটা মধুতে মিশে আছে এই দরিদ্র প্রান্তিক চাষি ও দিনমজুর মৌয়ালদের স্বেদ, রক্ত আর বাঘের আক্রমণে মৃত মৌয়ালদের পরিবারপরিজনের বুকফাটা কান্না। এই সব সাহসী কিন্তু অসহায় মৌয়ালদের জীবন মোটেই মধুময় নয়।

 

সুন্দরবন সম্বন্ধে আরোও জানুনঃ

সুন্দরবন পাঠঃ জানা অজানা কিছু তথ্য..

 

সুন্দরবন সম্বন্ধে বিশদ জানতেঃ

https://en.wikipedia.org/wiki/Sundarbans 

 

Published By: আশ শেফা মধু ঘ

 

আশ শেফার মধু- বাংলাদেশের সেরা মধুঃ

আশ শেফা আপনার জন্য বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শুধু খাঁটি মধুই সংগ্রহ করে না, মধুর সর্বোচ্চ মানও নিশ্চিত করে। তাই আশ শেফা মধুঘরের মধু নিঃসন্দেহে খাঁটি তো বটেই, পাশাপাশি মানের দিক থেকেও দেশ সেরা। আশ শেফার অনলাইন স্টোরে বিভিন্ন ধরণের মধু রয়েছে।  এখান থেকে বাংলাদেশের যে কোনো প্রান্ত হতে নিশ্চিন্তে খাঁটি মধু সংগ্রহ করতে পারেন। খাঁটি স্বাস্থ্যকর মধুর ক্ররয় নিশ্চিত হওয়ার জন্য আশ শেফার মধুর সম্পর্কে আরও যে কোনও বিস্ততারিত তথ্যের জন্য অনুগ্রহ করে আশ শেফা মধুঘরের সাথে 01919442385 নাম্বারে বা অনলাইনে ashshefa.com এ যোগাযোগ করুন।

  মধুর সম্পর্কিত আরও তথ্য এখানে পাবেন:

১. মধু ও শারীরিক সুস্থতা > টপিক:শারীরিক সুস্থতায় মধু গুণাগুণঃ

পর্ব-০১: https://www.facebook.com/102914111160597/posts/164428901675784/

পর্ব-০২: https://www.facebook.com/102914111160597/posts/167357614716246/

২. মধু ও স্বাস্থ্য > টপিক:সাধারন জ্বর, ঠান্ডা, কাশি প্রতিরোধে মধুর ঔষধি গুণঃ

https://www.facebook.com/102914111160597/posts/153922509393090/

2 thoughts on “বাদাবন বা সুন্দরবন, মউলি বা মৌয়াল, মৌমাছি, মধু ও বাঘ এর গল্প”

  1. sheikh amanur rahman

    অনেক তথ্যবহুল লেখা।
    (আমি যতটুকু জানি ঐখানে শ্রমদাসের একটা প্রথা (দাস প্রথা) চালু আছে। আপনার কাছে যদি এ বিষয়ে কোন তথ্য থাকে তবে ভবিষ্যতে কিছু লিখবেন, আশা রাখি)
    শেষের অংশটুকু পড়ে মনে কিছু কষ্ট বোধ করলাম।

    1. শুনে ভালো লাগলো। ইনশাল্লাহ।
      মতামতের জন্য অশেষ ধন্যবাদ :-)..

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আশ শেফা মধুঘর

FREE
VIEW