টপিকঃ জ্বর এবং মধু
আমাদের মধ্যে কমবেশি সবাই কখনো না কখনো এই জ্বরের স্বীকার হয়েছি। জ্বর হয়নি একথা কেউ বলতেই পারবে না। কোনো জ্বর না হোক ভাইরাস জ্বর কিংবা ম্যালেরিয়া দ্বারা কমবেশি সবাই আক্রান্ত হয়েছি। অথচ এই অতি সাধারণ রোগটা সম্পর্কে আমাদের মধ্যে বেশিরভাগ মানুষেরই খুব একটা স্বচ্ছ ধারণা নেই।
একজন সুস্থ মানুষের জন্য মুখে ৩৩.২-৩৮.২0 সে., পায়ুপথে ৩৪.৪-৩৭.৮0 সে.,কান পর্দায় ৩৫.৪-৩৭.৮0 সে. এবং বগলে ৩৫.৫-৩৭.০0 সে. ই হল স্বাভাবিক তাপমাত্রা । দেহের স্বাভাবিক তাপমাত্রা অনেকগুলো বিষয়ের ওপর নির্ভর করে যেমন বয়স, লিঙ্গ, সময় ,পারিপার্শ্বিক তাপমাত্রা, কাজের মাত্রা ইত্যাদি। তাপমাত্রা বৃদ্ধি মানেই জ্বর নয়। একজন সুস্থ লোক যখন ব্যায়াম করে তখন তার দেহের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেতে পারে কিন্তু তা জ্বর হিসেবে গণ্য হবে না যেহেতু তার মস্তিষ্কে নিয়ন্তিত নির্দিষ্ট সূচক (set point) স্বাভাবিক। অন্য দিকে স্বাভাবিক তাপমাত্রা ও কারও জন্য জ্বর হিসেবে গণ্য হতে পারে। যেমনঃ অসুস্থ রোগীর (যে দেহের তাপ উৎপাদনে দুর্বল) ৩৭.৩0 সে. ই জ্বর হিসেবে গণ্য হবে।
বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মানুষ জ্বর হলে খুব একটা গুরুত্ব দেন না এবং প্রায়ই দেখা যায় বাড়ির পাশের ওষুধের দোকান থেকে একপাতা নাপা কিনে এনে খাওয়া শুরু করে দেন ডাক্তারের সাথে কোনো রকম পরামর্শ ছাড়াই। জ্বর যদি সাধারণ হয় অর্থাৎ খুব বেশি মারাত্নক না হয় তবে এটুকুই যথেষ্ট। কিন্তু কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা যায় মারাত্নক কোনো রোগের লক্ষণ হিসেবে আমাদের শরীরে জ্বর আসে। জ্বর কেবলমাত্র একটা সিম্পটম। অন্য কোনো রোগের কারনেও এটি অাসতে পারে,যা বেশিরভাগ সময় আমরা অবহেলা করে থাকি। যা আমাদের জন্য ক্ষতির কারন হয়ে থাকে।
সাধারনত কয়েকধরনের জ্বর হয়ে থাকে। এর মধ্যে ক্লাসিকাল টাইপগুলি হলো:
একটানা জ্বর; হঠাৎ জ্বর বেড়ে যাওয়া ও কমে যাওয়া; স্বল্প বিরতিতে জ্বর; দীর্ঘ বিরতিতে জ্বর; তরঙ্গায়িত জ্বর; পুনর্বিরতিতে জ্বর ইত্যাদি।
তাপমাত্রা পরিবর্তনের ধরন রোগের উপর নির্ভরশীল: জ্বর এর পরিবর্তনের ধরন থেকেই কখনো কখনো রোগ নির্ণয় সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যেতে পারেঃ
একটানা জ্বরঃ সারাদিন ধরে শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি থাকে এবং ২৪ ঘণ্টায় ১0 সে. এর বেশি তাপমাত্রার পরিবর্তন হয় না। যেমনঃ লোবার নিউমোনিয়া, টাইফয়েড, মূত্রনালির ইনফেকশন, ব্রুসেলসিস, টাইফাস ইত্যাদি রোগের ক্ষেত্রে একটানা জ্বর পরিলক্ষিত হয়। টাইফয়েড রোগের ক্ষেত্রে জ্বরের একটি নির্দিষ্ট আঙ্গিক দেখা যায়। জ্বর ধাপে ধাপে বাড়ে এবং উচ্চ তাপমাত্রা অনেকক্ষণ থাকে।
নির্দিষ্ট বিরতিতে জ্বরঃ জ্বর একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত বাড়ে এবং পরে তাপমাত্রা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যায়, যেমনঃ ম্যালেরিয়া, কালাজ্বর (kala-azar), পাইয়েমিয়া, সেপ্টিসেমিয়া (রক্তের সংক্রমন)। এর প্রকারভেদগুলো হলঃ
কুয়োটিডিয়ান জ্বরঃ যার পর্যায়কাল হল ২৪ ঘণ্টা, সাধারণত ম্যালেরিয়ার ক্ষেত্রে দেখা যায়।
টারশিয়ান জ্বরঃ যার পর্যায়কাল ৪৮ ঘণ্টা, এটিও ম্যালেরিয়ার ক্ষেত্রে দেখা যায়।
কোয়ার্টান জ্বরঃ যার পর্যায়কাল ৭২ ঘণ্টা, এটি দেখা যায় Plasmodium malariae জীবাণুর ক্ষেত্রে।
স্বল্প বিরতিতে জ্বরঃ শরীরের তাপমাত্রা সারদিন স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি থাকে এবং ২৪ ঘণ্টায় ১0 সে. এর চেয়ে বেশি উঠা নামা করে। যেমনঃ infective endocarditis.
Pel-Ebstein জ্বরঃ এই বিশেষ ধরনের জ্বরটি হজকিন লিম্ফোমা এর ক্ষেত্রে দেখা যায়। জ্বর এক সপ্তাহ বেশি, এক সপ্তাহ কম- এভাবে চলতে থাকে। তবে আদৌ এ ধরনের জ্বর বিদ্যমান কিনা তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।
দেহের স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার অবর্তমানে এক ধরনের জ্বর দেখা যায় যাকে বলা হয় “ফিব্রাইল নিউট্রোপেনিয়া ” ।এক্ষেত্রে রোগ প্রতিরোধী নিউট্রোফিল এর অভাবে ব্যাক্টেরিয়ার সংক্রমন তাড়াতাড়ি ছড়িয়ে পরে। তাই এই রোগের জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন। যেসব রোগীর কেমোথেরাপি চিকিৎসা চলছে যা কিনা দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয় তাদের ক্ষেত্রে এই রোগ বেশি দেখা যায়।
Febricula, এটি একটি প্রাচীন শব্দ যা এমন ধরনের জ্বরের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয় যখন তাপমাত্রা বেশি উঠে না এবং বিশেষ করে যখন জ্বরের কারণ অজানা থাকে। এ ধরনের জ্বর থেকে রোগী এক সপ্তাহে সেরে ওঠে।
আপনার অথবা আপনার বাসার কারো জ্বর হলে আপনার প্রথম কর্তব্য হবে যেনতেন ওষুধ না খেয়ে ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করা। কারণ কীভাবে অথবা কী কারণে জ্বর এসেছে তা আমাদের মত সাধারণ মানুষের পক্ষে সঠিকভাবে জানা সম্ভব নয়। বিশেষ করে জ্বর যদি তিনদিন অতিক্রম করে যায় তাহলে তা মারাত্মক ক্ষতিকর হতে পারে। এ অবস্থায় সময় নষ্ট না করে করে অতি দ্রুত ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করতে হবে। এছাড়া কিছু নির্দিষ্ট খাবার আছে যেগুলো কিছু জ্বর উপশম করে এবং সকল জ্বর উপশম না করলেও জ্বরের সময় অনেক আরাম দেয়। আর আছে মধু।
মধু ও তুলসিপাতা:
ঠান্ডা লেগে জ্বর হলে সেই সমস্যায় খাঁটি মধু বেশ উপকারী। মধু আর তুলসিপাতা গলার কফ পরিষ্কার করে দেয়। সর্দিকাশি হলে প্রতি সকালে মধু আর তুলসিপাতা একসঙ্গে খেয়ে নিন। কাশি সারবে, সঙ্গেও জ্বরও।
মধু আদা চা:
জ্বরের অস্বস্তি থেকে মধু আদা চা পারবে আপনাকে সহজেই রেহাই দিতে। শুধু গলার কফ সারাতেই নয়, বুকের কফ পরিষ্কার করতেও মধু আদা চায়ের তুলনা হয় না। মধু আদা চা বানাতে ফুটন্ত পানিতে চা দিয়ে ফুটিয়ে এরপর এতে দিন পরিমান মতো আদার কুচি। অল্পক্ষণ পর ছাঁকনি দিয়ে ছেঁকে নিন চা। এরপর মিশিয়ে নিন স্বাদমতো খাঁটি মধু। এই মধু আদা চা খেলে সর্দির সময় মাথা ধরা কমে যায়। মধুর কারনে একইসঙ্গে দুর্বলতা কেটে গিয়ে শরীর চাঙ্গা হয়ে ওঠে।
মধু ধনিয়া চা:
এক গ্লাস পানিতে এক টেবিল চামচ ধনিয়া দিয়ে জ্বাল দিন। জ্বাল হয়ে গেলে এতে দুধ এবং স্বাদমতো খাঁটি মধু মিশিয়ে নিন। এবার এই চা পান করুন। ধনিয়া মধুতে থাকা ভিটামিন এবং অ্যান্টিবায়োটিক উপাদান রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করবে এবং জ্বর, ফ্লু সারিয়ে তুলবে।
মধু তুলসি:
তুলসির অ্যান্টি ফাঙ্গাল, অ্যান্টি ইনফ্লামেনটরী এবং অ্যান্টি ভাইরাল উপাদান ভাইরাস জ্বর সারিয়ে তুলতে সাহায্য করে। গরম পানিতে কিছু পরিমাণ তুলসি পাতা জ্বাল দিয়ে নিন, মিশিয়ে নিন খাঁটি মধু। এই পানীয়টি দিনে কয়েবার পান করুন। দেখবেন জ্বর দ্রুত ভাল হয়ে গেছে।
রসুন এবং মধু:
মধুর সাথে এক টুকরো রসুন কুচি করে মিশিয়ে নিন। এই মিশ্রণটি দিনে দুই থেকে তিনবার খান। রসুনের অ্যান্টিবায়োটিক এবং ওষুধি উপাদান শরীরের অভ্যন্তরীণ ব্যাকটেরিয়া দূর করে জ্বর সারিয়ে তোলে।
মধু ও মেথি:
এক টেবিল চামচ মেথি আধা কাপ পানিতে সারারাত ভিজিয়ে রাখুন। পরের দিন সকালে সেই মেথি পানির সাথে লেবুর রস এবং মধু মিশিয়ে পান করুন। মধু এবং মেথির সমন্বিত ওষুধি গুণাবলী ভাইরাল জ্বর সারাতে সাহায্য করে।
খাঁটি মধু ও ভিটামিনযুক্ত খাবার:
শরীরে ভিটামিনের অভাব হলে শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে। তখন বাইরের রোগজীবাণু সহজেই শরীরকে আক্রমণ করে। জ্বরও একই কারণে হয়ে থাকে। তাই জ্বর কমাতে হলে বা প্রতিরোধ করতে হলে ভিটামিন খাওয়া জরুরি। অনেকেই শরীরে ভিটামিন পেতে বেছে নেন ভিটামিনস সাপ্লিমেন্টস। কিন্তু সবসময় ভিটামিন সাপ্লিমেন্টস না খেলেও চলে। কিছু কিছু খাবার থাকে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন এ বি সি ইত্যাদি। আর খাঁটি মধু তে তো রয়েছে ভরপূর ভিটামিন, মিনারেলস এবং এনজাইম সহ বহু ধরনের প্রয়োজনীয় খনিজ। তাই মধুর সমন্বয়ে খাবারের একটি ঠিকঠাক তালিকা তৈরি করার চেষ্টা করুন যাতে শরীরে সবধরনের ভিটামিন ঠিকমত প্রবেশ করতে পারে। ভিটামিন শরীরের রোগপ্রতিরোধে অংশ নেয়।
খাঁটি মধু মিশ্রিত তরল খাবার :
কফ একবার বুকে জমে গেলে তা বের করা কঠিন। এমনকি ঠিকমতো চিকিৎসা না করাতে পারলে হতে পারে ইনফেকশনও। তাই কোনোভাবেই যেন বুকে কফ বসে না যায়। এজন্য খেতে হবে প্রচুর পরিমাণ তরল। শুধু পানিই খেতে হবে এমন নয়। বরং চলতে পারে ফ্রুট জুস বা স্যুপ জাতীয় খাবারও। এই তরল কফকে সহজে বুকে বসতে দেয় না। বরং বুকে থাকা কফকে তরল করে দিয়ে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করে। তরল কফ বের করে আনতে হালকা কুসুম গরম পানির সাথে লেবুর রস এবং দু’চামচ মধুও কিন্ত বেশ উপকারী।
সুতরাং বুঝতেই পারছেন,সিজন চেঞ্জের এ তুমুল ধাক্কায় নিজের শরীর সুস্থ রাখা কতটা জরুরী! আর সুস্থ শরীর বজায় রাখার এ জার্নিতে খাঁটি মধুর বিকল্প আর কিই বা আছে? অবএব,কিছু পরিমান খাঁটি মধু অবশ্যই নিজেদের সংরক্ষনে রাখুন যাতে প্রয়োজনে মার্কেটের রমরমা মোড়কে মোড়ানো ভেজাল মধুর মুখাপেক্ষী কখনোই হতে না হয়।