আশ শেফা মধুঘর

কুরআন এ মৌমাছির সহজ সরল পথ ও তাদের ভাষা মৌ নৃত্যের বঙ্গানুবাদ

বিংশ শতাব্দীর আগ পর্যন্ত বিজ্ঞানিদের মৌমাছির জীবন চক্র নিয়ে সুস্পষ্ট কোন ধারনা ছিলো না। তারা গতানুগতিক একটি ধারনার উপর মনে করতো, মৌমাছি দুই রকমের।
একটি হলো- পুরুষ মৌমাছি। এদের কাজ স্ত্রী মৌমাছিদের সন্তান উৎপাদন কার্যে সহায়তা করা,গৃহ (মৌচাক) নির্মাণ,ফুল থেকে মধু সংগ্রহ,গৃহ পাহারা দেওয়া ইত্যাদি।
আরেকটি হলো- স্ত্রী মৌমাছি(Queen Bee)।এদের কাজ হলো শুধু সন্তান উৎপাদন।
এটি ছিল বিজ্ঞানিদের প্রথমদিকের ধারনা।

শেক্সপিয়ারের অনেকগুলো বিখ্যাত নাটকের একটি হলো- ‘Henry The Fourth’। ধারনা করা হয়,শেক্সপিয়ার এটি লিখেছিলেন ১৫৯৭ সালের দিকে, এবং এটি প্রিন্টেড হয় ১৬০৫ সালের দিকে।সেই নাটকে এক পর্যায়ে বলা হয়েছে, পুরুষ মৌমাছিরা মধু সংগ্রহ করে এবং তাদের একজন রাজা থাকে। দিনশেষে সব সৈনিক মৌমাছিদের এই ‘রাজা’ মৌমাছির কাছে এসে কৈফিয়ত দিতে হত কি কি কাজ তারা পুরোদিনে করেছে। এটি ছিল শেক্সপিয়ারের সময়কার লোকজনের মৌমাছি নিয়ে ধারনা। কিন্তু বিজ্ঞান তখনও আবিষ্কার করতে পারেনি আসল কাহিনীটা।

 

 

১৯৭৩ সালে অষ্ট্রিয়ান বিজ্ঞানি Karl Von-Frisch ‘Physiology or Medicine’ বিষয়ে সফল গবেষণার জন্য চিকিৎবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন। তার গবেষণার বিষয় ছিল ‘মৌমাছির জীবনচক্র’। তিনি এই বিষয়ে একটি বই লিখেছেন যার নাম ‘The dancing bees’।

 

তিনি বৈজ্ঞানিক ভাবে(ফটোগ্রাফি এবং অন্যান্য পদ্ধতি অবলম্বন করে) প্রমান করে দেখিয়েছেন যে, মৌমাছি তিন ধরনের।

প্রথমটি হচ্ছে- স্ত্রী মৌমাছি। এদের কাজ শুধু সন্তান উৎপাদন। আর কোন কাজেই এরা অংশগ্রহণ করে না। দ্বিতীয়টি হচ্ছে- পুরুষ মৌমাছি। এদের কাজ হচ্ছে শুধু স্ত্রী মৌমাছিদের (Queen bee) সন্তান উৎপাদনের জন্য প্রজনন প্রক্রিয়ায় সহায়তা করা। এর বাইরে এরা আর কোন কাজ করে না। তৃতীয়টি হচ্ছে- এরাও স্ত্রী মৌমাছি কিন্তু বন্ধ্যা। মানে,এরা কখনই সন্তান উৎপাদন করতে পারে না। প্রাকৃতিক ভাবেই এরা বন্ধ্যা হয়ে থাকে। এদের অন্য নামে বলা হয়- ‘কর্মী মৌমাছি’। মৌচাক নির্মাণ,মধু সংগ্রহ সহ তাদের যাবতীয় কাজ সম্পাদন করে এই কর্মী স্ত্রী মৌমাছিরাই। পুরুষ মৌমাছি এবং স্ত্রী (Queen bee) মৌমাছি সন্তান উৎপাদন ছাড়া মৌচাক নির্মাণ,মধু সংগ্রহ সহ অন্যকোন কাজেই অংশগ্রহণ করে না। এসব করে কর্মী মৌমাছি বা দ্বিতীয় ক্যাটাগরির স্ত্রী মৌমাছি। (এদের Queen bee বলা হয়না, Worker Bee বলা হয়)।

 

তিনি আরো প্রমান করে দেখিয়েছেন যে, যখনই একটি কর্মী মৌমাছি নতুন কোন ফুলের বাগান বা উদ্যানের সন্ধান পায়, তখন সাথে সাথে গিয়ে অন্য কর্মী মৌমাছিদের নতুন এই ফুলের বাগান/উদ্যানের সঠিক দিক নির্দেশনা জানিয়ে দেয়। Karl Von-Frisch এটার নাম দিয়েছেন ‘Waggle Dance’।

শেক্সপিয়ায়ের সময়কার পুরো বিশ্বাস পাল্টে দিয়েছে বিজ্ঞানি Karl Von Frisch এর এই আবিষ্কার।

এবার চলুন কোরআন কি বলে দেখা যাকঃ

কোরআনে মৌমাছির নামানুসারে একটি পুরো সূরা আছে। সেটি হলো- সূরা আন-নাহল। আরবিতে ‘নাহল’ মানে মৌমাছি। এই সূরার ৬৮ এবং ৬৯ নং আয়াতে সরাসরি মৌমাছি নিয়ে কথা বলা হয়েছে।

প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে একটি ব্যাপারে বলে নিই, সেটি হচ্ছে – বাংলা/ইংরেজিতে ক্রিয়ার (Verb) কোন লিঙ্গান্তর হয়না। মানে, ক্রিয়ার পুংলিঙ্গ/স্ত্রী লিঙ্গ হয়না। আমরা ইংরেজিতে পুংলিঙ্গ এবং স্ত্রী-লিঙ্গের জন্য একই verb ব্যবহার করি।

যেমন, He does the work.. (পুং লিঙ্গের জন্য does) আবার, She does the work.. (স্ত্রী লিঙ্গের জন্যও does)। কিন্তু এ্যারাবিকে এরকম নয়।এ্যারাবিকে পুংলিঙ্গ এবং স্ত্রী লিঙ্গের জন্য আলাদা আলাদা verb ব্যবহৃত হয়। যেহেতু, আল কোরআন আরবি ভাষায় নাজিল হয়েছে, তাই আমাদেরকে আরবি ব্যাকরণ দিয়েই কোরআনে এ দু আয়াত বুঝতে হবে। (ইন ফ্যাক্ট সমগ্র কুরআনই এবাবে বুঝতে হবে।)

এবার সূরা আন নাহলের ৬৮ আয়াতে চলে যাওয়া যাক। আয়াতটি হলোঃ-

“وَ اَوْحٰى رَبُّكَ اِلَى النَّحْلِ اَنِ اتَّخِذِیْ مِنَ الْجِبَالِ بُیُوْتًا وَّ مِنَ الشَّجَرِ وَ مِمَّا یَعْرِشُوْنَۙ”,

বাংলা উচ্চারনঃ ‘ওয়া আওহা রাব্বুকা ইলান নাহলি আনিত্তাখিযি মিনাল জিবালি বুইঊতাও ওয়া মিনাশ শাজ্বারি ওয়া মিম্মা ইয়ারিশুন।’

বাংলা অর্থ- ‘তোমার রব মৌমাছিদেরকে একথা অহীর মাধ্যমে বলে দিয়েছেনঃ তোমরা পাহাড়-পর্বত, গাছপালা ও মাচার ওপর ছড়ানো লতাগুল্মে নিজেদের চাক নির্মাণ করো।’

আপনি যদি আরবি ভাষা জানেন বা আরবি ব্যাকরণ বুঝেন, তাহলে অবশ্যই আপনার জানার কথা ‘পুরুষ মৌমাছি’র জন্য আরবিতে ব্যবহৃত শব্দ হলো- ‘ইত্তাখিজ’, আর ‘স্ত্রী মৌমাছি’র জন্য ব্যবহৃত শব্দ হলো- ‘ইত্তাখিজি’। আলাদা আলাদা শব্দ। উপরের আয়াতে দেখুন, ওয়া’তালা এখানে ‘ইত্তাখিজ’ ব্যবহার না করে ‘ইত্তাখিজি’ শব্দ ব্যবহার করেছেন। তাহলে নিশ্চিতরূপে বোঝা গেলো- উক্ত আয়াতে মৌমাছির প্রতি যে নির্দেশ দেওয়া হলো, তা অবশ্যই অবশ্যই স্ত্রী মৌমাছির জন্য।

যদি পুরুষ মৌমাছিকে ইনডিকেইট করা হতো, তাহলে উক্ত আয়াতে কখনোই ‘ইত্তাখিজি’ ব্যবহার হতোনা, ‘ইত্তাখিজ’ শব্দ ব্যবহার করতে হতো। যদি ‘ইত্তাখিজ’ শব্দ ব্যবহার হতো,তাহলে সেটা আরবি ব্যাকরণ অনুসারে ভুল তো হতোই, মডার্ন সাইন্স অনুসারেই সেটা ভুল প্রমান হতো।

বিজ্ঞানি Karl Von-Frisch প্রমান করে দেখিয়েছেন যে, মৌচাক নির্মাণ, মধু সংগ্রহ ইত্যাদিতে পুরুষ মৌমাছি নয়, স্ত্রী মৌমাছিই অংশ নেয়। চিন্তা করুন, বিজ্ঞান যেটা জানতে পারলো ১৯৭৩ সালে, কোরআন সেটা কতো আগেই সু-স্পষ্ট ভাবে বলে দিয়েছে। সুবাহান-আল্লাহ।।

Karl Von Frisch প্রমান করেছেন, একটি কর্মী মৌমাছি যখন কোন নতুন ফুলের বাগান/উদ্যানের সন্ধান পায়, সাথে সাথে অন্য কর্মী মৌমাছিদের সেই উদ্যান সম্পর্কে অবহিত করে। এক্সাক্টলি যে পথে গিয়ে মৌমাছিটি এই উদ্যানের সন্ধান পায়,অন্যদেরও ঠিক সে পথের সন্ধান দেয়। পথের এই সন্ধান দানে মৌমাছিটি কোনরকম হেরফের করেনা। সে যে পথে গিয়ে তা দেখেছে, ঠিক তাই-ই অন্যদের জানায়। অন্যপথ দিয়ে যেতে বলেনা।
সুরা নাহলের ৬৯ নং আয়াত দেখুনঃ

‘অত:পর, চোষন করে নাও প্রত্যেক ফুল থেকে, এবং চলতে  থাকো স্বীয় রবের সহজ-সরল পথে’।

লক্ষ্য করুন, এখানে আল্লাহ বলছেন, ‘চলো স্বীয় রবের সহজ – সরল পথে’।

আচ্ছা, এটি কি মানুষকে বলা ‘সহজ-সরল’ পথ বা ‘সিরাতুল মুস্তাকিম’? উত্তর হলোঃ না। কেন? কারন, মানুষের পরকালে জবাবদিহির দায় আছে, মৌমাছির তা নেই। তাহলে তাদের কোন সহজ-সরল পথে চলার কথা বলা হচ্ছে? অবশ্যই, এটি Karl Von Frisch এর সেই মৌমাছিদের ‘Waggle Dance’। এগ্জাক্ট সে পথ, যা তারা জানে। যা তার জন্য সহজ এবং অন্যান্যদের জন্যও সহজ! সুবাহান-আল্লাহ!!

১৯৭৩ সালে যা আবিষ্কারের জন্য বিজ্ঞানি Karl Von Frisch চিকিৎসা বিজ্ঞানে নোবেল পেয়েছেন, আল্লাহ সুবাহান ওয়া’তালা তা কোরআনে চৌদ্দশত বৎসর আগেই জানিয়ে রেখেছেন!

এবার চলুন, মৌমাছির ‘Waggle Dance’ সহ তাদের অন্যান্য আরোও কিছু Dance নিয়ে বিস্তারিত জনা যাক। (নড়ে চড়ে বসুন, বেশ ইন্টারেস্টিং কিন্তু! ☺)

তার আগে প্রথমে একটু ভুমিকা করা যাকঃ

পশু-পাখি, পোকা-মাকড়ের খাবার খোঁজাকে বিজ্ঞানীরা ইংরেজীতে বলেন ফোরেজিং (Foraging)। মানুষ, কুকুর, বিড়ালরা এরা একলা-একলাই জীবন কাটায়, বাঁচার জন্য এদের এক আল্লাহ ছাড়া কারোর ওপর নির্ভর করতে হয়না। তাই এইসমস্ত প্রাণীদের বিজ্ঞানীরা বলেন সলিটারী বা একান্তবাসী জীব। আবার, পিঁপড়ে-মৌমাছিরা একা একা কখনো বাঁচতে পারে না, একটা পিঁপড়ে কলোনী বা মৌমাছির চাকের বাসিন্দারা একে অন্যের ওপর নির্ভরশীল। তাই মানুষের মতো এদেরকেও বলা হয় সোশ্যাল বিইং বা সামাজিক জীব।

আচ্ছা, আমরা তো কম বেশী সবাই জানি, একটা মৌমাছির চাকে রানী মৌমাছি আর পুরুষ মৌমাছির একমাত্র কাজ হলো বংশ বিস্তার করা। আর বাকী সব কাজ, যেমন চাকের সবার খাবার জোগাড়, ডিম-বাচ্চাদের লালন-পালন, মৌচাককে শত্রুদের থেকে রক্ষা করন, রানী-পুরুষ মৌমাছিদের পয় পরিস্কার রাখা, এই সবকিছুরই দায়িত্ব হলো কর্মী মৌমাছিদের। স্বাভাবিক ভাবেই একটা কর্মী মৌমাছির পক্ষে সবকিছু করা সম্ভব নয়, তাই কর্মী-মৌমাছিরা তাদের কাজকে সুষ্ঠুভাবে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করে নিয়ে যে যার দায়িত্ব পালন করে।

সমগ্র কর্মী-মৌমাছিদের মধ্যে একটা নির্দিষ্ট ইউনিটের ভাগে দায়িত্ব পড়ে চাকের মধু বানানোর জন্য ফুলের সূধা এবং নিজেদের খাবারের মৌ রুটি (মধু ও পরাগ মিশ্রিত একপ্রকার মন্ড) তৈরির জন্য ফুলের পরাগ খোঁজার। বৈজ্ঞানিক পরিভাষায় এই মৌমাছিদের বলা হয় ফোরেজার বা জোগাড়ে মৌমাছি। আর সাধারন পরিভাষায় বলা হয় অনুসন্ধানী বা স্কাউট মৌমাছি বা ড্রোন মৌমাছি।

ফুলের সন্ধানে প্রথমে অল্প কিছু স্কাউট মৌমাছি চাকের চারিদিকে উড়ে যায়।

প্রথমত, তাদের লক্ষ্য থাকে সর্বাধিক ফুলের সূধা এবং ফুলের পরাগে সংস্থানকারী সর্বাধিক ফুলের সন্ধান করা। তবে তারা তাদের লক্ষ্য একই সঙ্গে সূধা এবং পরাগে ফোকাস করে না, প্রয়োজনানুসারে যে কোন একটির খোঁজে থাকে।

দ্বিতীয়ত, মৌমাছিরা কোন ফুলের প্রজাতিটি সর্বাধিক সূধা বা পরাগে ভরপুর, তার সন্ধান করে এবং মনে রাখে। কাজটা মৌমাছির পক্ষে বেশ সহজ। কারন মৌমাছিরা বিশ্বকে আপনার বা আমার থেকে একেবারে আলাদাভাবে দেখে। যদিও তাদের লাল রং আলাদা করতে অসুবিধা হয়, তবে তারা নীল, সবুজ এবং বেগুনি রঙের পাশাপাশি এমন কিছু রঙ দেখতে পারে যা আমরা পারি না। যেমন মৌমাছিরা এমন আলট্রা ভায়োলেট বা অতি বেগুনি আলো দেখতে পায়। এ আলোর সাহায়্যে মৌমাছিরা ফুলের বাইরে থেকেই ফুলের ভেতরে লুকিয়ে থাকা সুধা শনাক্ত করে ফেলে।

কোন স্কাউট মৌমাছি যখন কোথাও সুধা বা পরাগ সম্বলিত কোনও ভাল ফুল খুঁজে পায় তখন সে সেটার স্যাম্পল হিসেবে কিছু সুধা মুখে করে বা পরাগের সন্ধানে থাকলে কিছু পরাগ পায়ের সাথে লাগিয়ে এনে মৌচাকে ফিরে এসে তার সংগৃহীত নমুনা দলের অন্যান্য কর্মী মৌমাছিদেরকে ভাগ ভাগ করে দেখতে দেয়।

এ পর্যায়ে ভুমিকা রাখে কিছু পর্যবেক্ষক মৌমাছি, যারা মান নিয়ন্ত্রকের ভুমিকা পালন করে। তারা তাদের নিজেদের পেটে আগে থেকে রাখা সুধা বা পরাগের নমুনার সাথে সংগৃহীত করে আনা নমুনার সাথে মিলিয়ে তা পুনর্বিবেচনা করে। এই পর্যবেক্ষক বা মান নিয়ন্ত্রক মৌমাছিরা সংগৃহীত করে আনা নমুনাটি যে ফুল থেকে আনা হয়েছে সে ফুলের ঘ্রাণও পেয়ে যায়। এই ক্লুগুলি মান নিয়ন্ত্রক মৌমাছিদের কাঙ্খিত ফুলটি সনাক্ত করতে সহায়তা করে। তারা রায় দেয় এ সুধার মধু কিংবা পরাগের খাবার ভালো হবে নাকি খারাপ হবে।

এর পর স্কাউট মৌমাছির কাজ হলো ফুলটা সে কোথায় দেখে এসেছে, বা কোনদিকে কতদুর গেলে বাকী মৌমাছিরাো ফুলটি খুঁজে পাবে সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানানো। এখন কথা হলো, মৌমাছি তো উড়ে উড়ে চলে, তাই তারা পিপড়ের মতো ফেরোমেন (বিশেষ রাসায়নিক পদার্থ) ক্ষরন করে সহজে খাবারের উৎসের ট্রেস রেখের আসতে পারে না। তাহলে কিভাবে সে অন্যদের এটা বুঝাবে? স্কাউট মৌমাছি পারত সেই ফুলের দিকে সবগুলি মৌমাছিকে নিজের পিছু পিছু নিয়ে যেতে। কিন্ত তারা সেটা করে না।

স্কাউট মৌমাছি যেটা করে সেটা হচ্ছে একটি বিশেষ নৃত্যের ছন্দে ছন্দে প্রথমে চাক থেকে ফুলের দূরত্বের একটা নিঁখুত হিসাব করে দেখায়। তারপর নৃত্যের ভঙ্গীর একটা বিশেষ ছন্দ ব্যবহার করে দিক টাও বুঝিয়ে দেয়।

এই ক্ষেত্রে তারা দুটি নৃত্য ব্যবহার করে। একটি হচ্ছে Round Dance বা গোল নৃত্য। আরেকটি হলো Waggle Dance বা স্পন্দন নৃত্য। ছবিঃ- ১

 

Round Dance বা গোল নৃত্যের দ্বারা স্কাউট মৌমাছিরা চাকের মৌমাছিদের ফুলের অবস্থান সম্পর্কে কেবল একটি জিনিসই বলে, তা হলোঃ “এটি মধুচক্রের কাছাকাছি কোথাও”।

এই নৃত্যে, মৌমাছি ঘুরপাক খেয়ে হেঁটে একটি বৃত্ত তৈরি করে, বৃত্ত তৈরি শেষ হলে সেই শেষ প্রান্তে সে একটি একটি লুপ তৈরি করে বিপরীত দিকে ঘুরে গিয়ে একই পথে আবার উল্টা হেঁটে বৃত্ত তৈরি করে। এটিই বারবার পুনরাবৃত্তি করতে থাকে। এ নাচের মাধ্যমে সে কাছাকাছি যে ফুলটি পেয়েছে তার গুণমানকেও নির্দেশ করে বলে মনে করা হয়। এই বৃত্তাকার নাচের অংশ হিসাবে মৌমাছি একটি বিশেষ অ্যাকোস্টিক সংকেতও তৈরি করে। এই শব্দ সংকেত দিকনির্দেশ সম্পর্কিত তথ্যের পাশাপাশি সুধা বা পরাগের উৎসের দূরত্বের একটি ইঙ্গিত দেয়।

আর Waggle Dance বা স্পন্দন নৃত্য এমন একটা নাচ, যেটা দেখে মৌচাকের অন্যান্য সহকারীরা বুঝতে পারে মধুর উৎস কোথায় আছে কেমন আছে। এই নাচ দ্বারা মৌমাছিরা বুঝে যায় একদম ঠিক কোন দিকে, ঠিক কতদুর গেলে সেই ফুলটা খুঁজে পাওয়া যাবে।

চাকের ভেতর অবস্থান করে দুরবর্তী ফুলের অবস্থান বোঝানো সহজ ব্যাপার নয় মোটেই। ফুলের অবস্থান বোঝানোর জন্য শুধু দূরত্ব বোঝালেই তো হবে না, চাকের কোন দিকে ফুলটা অবস্থিত, সেটাও তো জানা দরকার। এক্ষেত্রে ওরা সূর্যের অবস্থানের উপর ভিত্তি করে ফুলের অবস্থান নির্দেশ করে৷ কিভাবে? তারা অভিকর্ষ বল যেদিকে কাজ করে, মানে মাটির দিকটাকে নিচের দিক আর নাচার সময় সূর্য যেদিকে অবস্থান করে সেদিকটাকে উপরের দিক ধরে। তারা নাচের ভেতর এক পর্যায়ে সূর্যের সাথে একটা কোন তৈরী করে ফুলের উৎসের দিকে মুখ করে নিতম্ব দুলিয়ে এঁকেবেঁকে হাটে। এই হাঁটাটাই হচ্ছে একটা নাচের মতো। নাচ শেষ হওয়ার পর ডানপাশে অর্ধবৃত্তাকার পথ অতিক্রম করে আবার সে আগের যায়গায় ফিরে আসে তারপর পুনরায় সেই স্ট্যাইলিশড ড্যান্সিং সহযোগে ফুলের দিক নির্দেশ করে। তারপর আবার অর্ধবৃত্তাকার পথ পাড়ি দিয়ে বাম পাশ দিয়ে আগের অবস্থানে ফিরে আসে। এভাবে বাংলা “৪” মতো দেখায় তার ড্যান্সটা।

তার নৃত্যের মঝখানে যে জায়গাটিকে সে নিতম্ব দুলিয়ে হাঁটে সেটার দিকে ভালোমতো খেয়াল করে কর্মী মৌমাছিরা ধরে ফেলে হ্যা! মধু ঐ দিকেই আছে! যেমন ২ নং ছবি৷

 

প্রথম মৌমাছিটি ফুলের উৎস সূর্যের দিকে, তাই সে মৌচাকে আসার পর তার নাচের সোজা পথটি হয়েছে মৌচাকের নিচ থেকে খাড়া উপরের দিকে, অর্থাৎ সূর্যের দিক। দ্বিতীয় মৌমাছিটির ফুলের উৎস সূর্যের ঠিক উল্টা দিকে তাই মৌচাকে আসার পর তার নাচের সোজা পথটি হয়েছে মৌচাকের নিচ থেকে খাড়া নীচের দিকে, অর্থাৎ সূর্যের ঠিক বিপরীত দিকে।

তৃতীয় মৌমাছিটির ফুলের উৎস হলো মৌচাক থেকে যেদিকে সুর্য তার সাথে ৬০ডিগ্রী কোনে ডানদিকে৷ তাই মৌচাকে আসার পর তার নাচের সোজা পথটিও সূর্যের দিকের সাথে ৬০ ডিগ্রী কোন করে ডানদিকে হয়েছে৷ অন্য দিকে চতুর্থ মৌমাছিটির খাবারের উৎস হলো, যেদিকে সূর্য তার সাথে ১২০ ডিগ্রী কোনে ডানদিকে। তাই তার নাচের সোজা পথটি হয়েছে সূর্যের দিকের সাথে ১২০ ডিগ্রী কোন করে ডানদিকে।

কিন্তু এ পদ্ধতিতে বড় একটা সমস্যা এখনো রয়ে গেল! সমস্যাটা হলো একে তো সূর্য সবসময়ে সব ঋতুতে এক জায়গায় থাকে না, তার ওপর সে অনবরত সরে যেতে থাকে৷ প্রতি চার মিনিটে সুর্য এক ডিগ্রি করে পশ্চিমে হেলে পরে। তাহলে উৎস যদি অনেক দূরে হয় এবং ফিরে আসতে আসতে যদি স্কাউট মৌমাছির এক ঘন্টা লাগে ততক্ষণে সূর্য তো ১৫ ডিগ্রি হেলে পরবে। তখন?

তখন আসলে কিছুই হবে না। এরা খুব সুন্দর করে নিজেদের ইন্দ্রীয়ের সাথে প্রকৃতিকে মানিয়ে নিয়েছে।

সূর্য যখন একটু একটু করে সরে যেতে থাকে তখন এরাও একটু একটু করে উৎসের সাথে সূর্যের কোনের মান পরিবর্তন করতে থাকে। এমনকি, মেঘলা দিনেও এরা সূর্যের অবস্থান নির্নয় করতে পারে কারন মৌমাছির চোখের পুঞ্জাক্ষি অতি বেগুনি রশ্মি সনাক্ত করতে সক্ষম। তাই তারা মেঘে ঢাকা আকাশে অন্ধকারের মধ্যেও সূর্য ঠিক কোথায় আছে সেটি বলে দিতে পারে৷

সূর্যের আলো যখন বায়ুমণ্ডল ভেদ করে পৃথিবীতে প্রবেশ করে তখন বায়ুমণ্ডলের উপরিভাগের আয়নগুলির প্রভাবে polarized হয়ে যায় এবং এই polarization-এর দিক সূর্যের দিকে হয়, মানুষের চোখ সেটা ধরতে পারে না কিন্তু মৌমাছির পুঞ্জক্ষিতে তা ধরা পড়ে এবং আমরা যেভাবে ধ্রুবতারাকে দেখে দিক ঠিক করতে পারি সেইরকম মৌমাছিরাও সূর্যকে কম্পাস হিসেবে ব্যবহার করে চলাফেরা করে।

তাই যখন আকাশ মেঘলা থাকে, সূর্য মেঘের আড়ালে হারিয়ে যায়; তখন এরা এদের বিশেষ ফটো-রিসেপ্টর ব্যবহার করে পোলারাইজড আলো কাজে লাগিয়ে সূর্যের সঠিক অবস্থান বের করে ফেলে।

ব্যক্তিগত ভাবে স্কাউট মৌমাছি চাক থেকে ফুলের অবস্থান কতদূরে সেটি হিসাব করে কিছুটা আন্দাজে, সময়ের উপর নির্ভর করে। যদি ফুলটি দূরে হয় তাহলে সোজা পথটি অতিক্রম করার সময় বা waggle phase এ মৌমাছিটি বেশি সময় নেবে কাছে হলে কম সময়।

সোজা পথের নাচার সময় সময় দেখে অন্যেরা হিসাব করে নেয় কতদূরে খাবারের উৎস। গবেষনায় দেখা গেছে, প্রতি ১০০ মিটার দুরত্বের জন্য স্পন্দন নৃত্যের সময় ৭৫ মিলি সেকেন্ড করে বেড়ে যায়। বিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন যে, এক সেকন্ড ধরে নাচলে ফুল টা মোটামুটি এক কিলোমিটার দূরে থাকে।

 

মজার ব্যাপার হলো মৌমাছিদের দূরত্বের কোনো ধারণাই নেই, আছে শুধু সময়ের জ্ঞান। বেশিরভাগ প্রাণীর ক্ষেত্রেই সেটা সত্যি, এমনকি মানুষের ক্ষেত্রেও ! কেউ যদি জিজ্ঞাসা করে যে , “ ভাই অমুকের বাড়িটা কতদুর?” আমরা কিন্তু বলিনা যে, ” এই ৫০০ মিটার হবে।” বরং আমরা বলি, “বেশি না, এই দশ মিনিটের হাঁটা পথ।” মৌমাছিও তাই।

তার ওপর উল্টোদিক থেকে খুব জোরে হাওয়া দিলে, মৌমাছির কোনো ফুলে পৌঁছাতে অনেক বেশি সময় লাগে। তাই যখন হাওয়া দেয়, একই দূরত্বের জন্য মাঝের অংশের নাচটা মৌমাছিরা অনেক বেশি সময় ধরে নাচে। তাই, অন্য মৌমাছিদেরও ফুলে পৌঁছাতে কোনো ভুল হয় না।

এসব তথ্য এবং সূর্যের গতিবিধি’র নিখুঁত হিসেব করে মৌমাছি’রা ফুল/খাবার এর কাছে পৌঁছানোর নুন্যতম ও সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত দুরুত্ব বের করে ফেলে। গবেষণায় দেখা গেছে, মৌমাছির এই সকল হিসেবের দক্ষতা কম্পিউটারের চেয়ে বেশি এবং সময়ও লাগে কম। সুর্যের অবস্থান নির্নয়ে পৃথিবী গোল বিধায় হিসেবে যে বক্রতার একটা ব্যাপার আসবে তাও তারা তাদের নাচের মাধ্যমে প্রকাশ করে।

মৌমাছির আরেকটি নাচ হলো Tremble Dance বা কাঁপানো নাচ। কাঁপানো নাচ হ’ল এমন একটি নাচ যা পরিবেশন করা হয় স্কাউট মৌমাছি দ্বারা ফুল থেকে বয়ে নিয়ে আসা অমৃত রিসিভ করার জন্য আরও রিসিভার মধু মৌমাছি নিয়োগের জন্য। এই কাঁপানো নাচটি ১৯২০ এর দশকে কার্ল ভন ফ্রিচ প্রথম বর্ণনা করেছিলেন।

যখন স্কাউট মৌমাছিটি তার বয়ে আনা সুধা বা পরাগ চাকের রিসিভার মৌমাছির দ্বারা রিসিভ করতে বিলম্ব হয়, তখন সে দীর্ঘ বিলম্ব অনুভব করে তখন সে এই নাচ নাচে, ফলে সবাই বুজতে পারে চাকে রিসিভার মৌমাছির কমতি হয়েছে, বাড়াতে হবে।
Grooming Dance/ Grooming Invitation Dance বা কাঁপানো নৃত্য বলে মৌমাছির আরেকটা নাচ আছে। এ নাচ হ’ল মৌমাছিদের ব্যাক্তিগত পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা খাবার দাবার প্রদান ইত্যাদি কাজের জন্য একে অপরকে উজ্জিবীত করার জন্য একট আমন্ত্রনমূলক বা সাহায্য প্রার্থনামূলক নাচ। যেমন মৌমাছি তার দেহের শেষ প্রান্তে মুখ দিয়ে পরিস্কার করতে পাের না, গোসলের যেমন আমরা নিজের পিঠ নিজে পরিস্কার করতে পারি না, কোন কিছু বা অন্য কারোও সাহায্য প্রয়োজন হয়, বিষয়টা এমনই। এটি সর্বপ্রথম ১৯৪৫ সালে জীববিজ্ঞানী মাইকোলা এইচ হাদাক আবিস্কার করেন।

আশা করি আমরা অনেকটাই বুঝে গেছি মৌমাছির কম্যুনিকেশন সম্বন্ধে। এই বিষয়গুলোই আবিস্কৃত হতে সময় লেগে গেছে শত বৎসরের অধিক!

 

 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আশ শেফা মধুঘর

FREE
VIEW